আজকের এই অনুষ্ঠানকে আমরা যদি একটু অন্যভাবে দেখি, তাহলে আমরা এটিকে বিদায়ের অনুষ্ঠান না বলে মিলনের উৎসব বলতে পারি। আজ দীর্ঘদিন পর আমাদের বিদ্যালয়ের একই প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়েছেন আমাদের শ্রদ্ধেয় প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষিকা গন, বর্তমানে কর্মরত শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ এবং বিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্রছাত্রীরা। আজ আমরা সবাই একই সাথে যেন এক মিলন উৎসবে মিলিত হয়েছি। কবির ভাষায় বলতে গেলে- “উৎসব মানে এক মিলনের মেলা/ কিছু দেওয়া কিছু নেওয়া জীবনের খেলা।” আমরা শুরু করতে চলেছি আজকের নিবেদন – “জীবন তরী”।

মোর ভাবনারে কী হাওয়ায়

এবারে বর্ষা যেন কিছুতেই যেতে চাইছে না। প্রকৃতির উদার নিঃস্বার্থ প্রাচুর্য্যে আমরা হয়তো বা তিতিবিরক্ত। কিন্তু মেঘ ও বৃষ্টি বরাবরই আমাদের মনকে সতেজ করে এক অন্য ভাবনালোকে পৌঁছে দেয়।
মেঘ ও বৃষ্টির পৃষ্ঠপোষকতায় যখন প্রিয়মুখটি অন্তরাল থেকে আলোয় আসতে থাকে, আমরা আনন্দ ও উল্লাসে মেতে উঠি, আমাদের ভাবনাসমূহকে উদ্ভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত করে দিই। প্রিয়জনের নূপুরধ্বনির তরঙ্গহিল্লোলে তখন আপনা আপনিই বুকের ভেতর হারমনিকায় সুর বেজে ওঠে — ‘মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো,/ দোলে মন দোলে অকারণ হরষে।”

নীল অঞ্জনঘন

মেঘ ও বৃষ্টির প্রতি কবিগুরু বরাবরই দুর্বল। গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা // মন মোর মেঘের সঙ্গী // এমন দিনে তারে বলা যায় // আজি ঝরো ঝরো ইত্যাদি গানই তার প্রমান। একটা মজার ঘটনা বলি, শান্তিনিকেতনে একবার তীব্র দাবদাহে কবির প্রাণ ওষ্ঠাগত। সিদ্ধান্ত নিলেন কলকাতা হয়ে কালিম্পং যাবেন। মালপত্র ট্রেনে তোলা হচ্ছে, কবি গাড়িতে করে স্টেশনে আসছেন। এমন সময় আকাশে এক ঘন মেঘ দেখতে পেলেন গুরুদেব। ড্রাইভারকে বললেন, চল ফিরে চল। শান্তিনিকেতনে বৃষ্টি হবে নীল অঞ্জনঘন মেঘ থেকে, আর কবি তা দেখবেন না!

দেখ আলোয় আলোয় আকাশ

জীবন মানেই সুখ দুঃখের সহাবস্থান। এ সত্য আমরা সকলেই জানি। কিন্তু অনেক সময়েই আমরা জীবনের এমন খাঁদে পড়ে যাই, যা দেখে আমরা হয়তো দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ি- মুক্তির পথ খুঁজে পাই না। কিন্তু হাল ছেড়ো না বন্ধু। কবির ভাষায়… ‘মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে।’ আমাদের পরবর্তী নৃত্যে প্রকৃতি রয়েছে, আধ্যাত্মিক দর্শন রয়েছে,
সুন্দরের প্রতি আকুতি রয়েছে, মানব মনের অনুভূতির প্রকাশ রয়েছে, তেমনি রয়েছে মানব মন জাগ্রত করার সূক্ষ্ম, সচেতন আহ্বান- ” দেখ আলোয় আলোয় আকাশ…”

প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে

কবি একদিন জা্হাজের ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ আকাশের পান্ডুর নীল ও সমুদ্রের নিবিড় নীলিমার মাঝে পশ্চিম দিগন্তে মৃদু বাতাস বইছে। কবির মন খুশিতে ভরে উঠল। কবির মনে হল এ তার প্রসাদ সুধার প্রবাহ। এ বর্ণ নয়, গন্ধ নয়, এ যেন অমৃত। এ গান আকাশ ও সমূদ্রের রুপ দেখে লেখা। প্রকৃতি মিটিয়ে দিচ্ছে প্রাণের তৃষ্ণা, ভরে যাচ্ছে প্রাণ। কবি তখন পার হচ্ছেন লোহিত সমুদ্র। কবি লিখলেন – প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে…

ভরা থাক স্মৃতিসুধা

জীবন মানেই সময়ের স্রোতে ভেসে যাওয়া। আগমন আছে, বিদায় আছে। সময় আজ নয়তো কাল কিংবা কোনো একদিন আমাদের প্রিয় মানুষদের একে অপরের থেকে আলাদা করে দেয়। আজ আমরা এই স্কুলে আছি, আগামীতে থাকব না। এতে বেদনা আছে- কিন্তু শুধু বেদনাই নয়- আছে আনন্দ, আছে নতুনের খোঁজ। কিন্তু যাবার আগে আমরা যদি কিছু ভালো, কিছু মজার, কিছু আনন্দের স্মৃতি রেখে যেতে পারি- তাই হবে আমাদের আগামীর সুধা- স্মৃতি সুধা। কোনো একদিন – হয়তো কোনো একদিন – দূরদেশে থেকেও ডুবে যেতে পারবো এই স্মৃতিসুধায়- নস্টালজিয়ায় যেখানে স্মৃতি অনির্বাণ – চির উজ্জ্বল।