আমার বয়স যে বছর একুশ পূর্ণ হলো –
ভোট দিলাম।
দ্বিতীয়বার যখন চটের পর্দা-ঢাকা খোপরিতে ঢুকে
প্রগতিশীল প্রতীক চিহ্নে ছাপ মারছি তখন আমি ছাব্বিশ।
ঊনত্রিশ বছর বয়সেও বিশ্বের নিঃস্বতম গণতন্ত্র রক্ষার জন্য
আমার প্রাণ আকুল হয়ে উঠেছিলো।
কিন্তু এ বছর ভোটের দিন সারাদুপুর তক্তপোষে শুয়ে
বেড়ার ফোকর দিয়ে পতাকা-ওড়ানো রিকসার যাতায়াত দেখেছি
কিন্তু ভোট দিতে যাই নি।

না, আমি ভোট বয়কট করিনি
ভোট আমাকে বয়কট করেছে।
কারণ আমার বয়স একত্রিশ।
তিরিশের পর সরকারি চাকরি পাওয়া যায় না।
যে সরকার আমাকে চাকরি দেবে না –
সেই সরকার গঠনের জন্য
গায়ে আমার পুলক লাগে চোখে ঘনায় ঘোর –
এরকম আশা করা যায় না।
বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অবশ্য বয়স পাঁচ বছর শিথিলযোগ্য,
কিন্তু আমার ক্ষেত্রে বিশেষ কারণ
বিশেষভাবেই অনুপস্থিত।
অগত্যা সরকারি চাকরি পাবার একটাই উপায় আছে
সার্টিফিকেট জাল করে বয়স কমিয়ে ফেলা।
কিন্তু হে নন্দিত নেতৃবৃন্দ, যদিও আমার চোখের উপর
আপনাদের অনির্বচনীয় লীলাময় জীবন খোলা আছে
তবু জালিয়াৎ হতে পারবো না –
আমার বাবা সৎ ছিলেন।

এই গঞ্জের বাজারে, ন্যাড়া ছাতিমতলায়, কাঁচাপাকা চুলে,
পুরু কাচের চশমা চোখে যে বৃদ্ধটি কুঁজো হয়ে
মান্ধাতার আমলের টাইপরাইটারে
আমার এবং আমার মতো শত শত চাকরিপ্রার্থী এবং
ভোটদাতা অর্থাৎ আপনাদের পরমান্নদাতা যুবকের
হাজার হাজার দরখাস্ত টাইপ ক’রে দিতেন –
একদিন ভরদুপুরে তার বুকের বাঁদিকের লজঝড়ে টাইপমেশিনটা বিগড়ে গেল।
সেই ফাঁকা জায়গায় আমি কলা নিয়ে বসে পড়লাম।
কার্বাইডে পাকানো চালানী মর্তমান কলার রঙ
যদিও বোম্বাই-অভিনেত্রীর চটককেও হার মানায়,
তবু খেতে অতিশয় অখাদ্য, ফলে আমাকে ডাবের সঙ্গে
ভাব জমাতে হোলো।

পা ফাক করে দাঁড়িয়ে ধুতি-পাঞ্জাবী শার্ট-প্যান্ট যখন
সরু নল দিয়ে চোঁ চোঁ করে সুমিষ্ট জল টেনে নিতো,
তাদের দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে আমি এই গঞ্জের
ছিন্নবিচ্ছিন্ন মানুষের মর্মান্তিক মহিমাকে স্পর্শ করতাম।
ডাবের খোলাটি ছুঁড়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে, ভিতরে আঙুল ঢুকিয়ে
দেখতাম, অধিকাংশ অমেরুদণ্ডী বুদ্ধিজীবীদের মতোই,
ভিতরে শাঁস আছে কিনা।

তারপর চিরুনী ব্লাউজ ধূপকাঠি তরমুজ চাল
হোসিয়ারী মাল এবং ধূর্ত নেতা পূর্তমন্ত্রী হবার জন্য
যত বড় স্বপ্ন দেখে ঠিক সেই আয়তনের মিষ্টি কুমড়ো
অর্থাৎ একের পর এক বহুমুখী বাণিজ্য বিস্তারে আমি
বিড়লাকেও ছাড়িয়ে গেলাম, কিন্তু বেড়ালের ভাগ্যে
শিকে ছিড়লো না। ফলে প্রায় বিনা চিকিৎসায়
মা মারা গেলেন।

আমাদের এখানে গত কুড়ি বছরে আধখানা হাসপাতাল
হয়েছে, বাকি আধখানা আর হবে না, কারণ প্রধান রাজনৈতিক
দলের নেতারা অধিকাংশই ডাক্তার এবং তাদের
নার্সিং হোম আছে।

রোজ ভোর চারটেয় উঠে আমি যখন বস্তির
গণতান্ত্রিক খাটা পায়খানায় লাইন দিতাম,
মা নিজের – হাতে – দেওয়া ঘুঁটে জ্বালিয়ে চা করে দিতেন।
সেই স্যাঁতসেতে অন্ধকারে ধোঁয়াটে আগুনের সামনে
বসে-থাকা মা- কে আমার ভারতবর্ষ বলে মনে হোতো।
দিদির মৃতদেহ দড়ি কেটে নামাবার পর থেকে
মা একদম চুপ হয়ে গিয়েছিলেন।
যার সঙ্গে দিদির বিয়ে হয়েছিলো সে গরীব ছিলো এবং
ভালো ছিলো। কিন্তু দারিদ্র্য তাকে মহানও করেনি বা
খ্রীষ্ট্রের সম্মানও দেয় নি – এক চোরাকারবারি
শ্রমিকনেতার আড়কাঠিতে পরিণত করেছিলো। সে সেই
নেতাকে মহিলা সরবরাহ করতো –
সেই নেতার সঙ্গে মন্ত্রীর যোগাযোগ ছিলো,
মন্ত্রীর সঙ্গে কেন্দ্রের যোগ ছিলো,
কেন্দ্রের সঙ্গে পরিধির যোগ ছিলো,
পরিধির সঙ্গে ব্যাস এবং ব্যাসের সঙ্গে
ব্যাসার্ধের সংযোগ ছিলো এবং এইসব সূক্ষ্ম যোগাযোগগুলি
একসঙ্গে গিঁট লেগে একটা মোটা নাইলনের দড়ি হয়ে
দিদির গলায় ফাঁস লাগিয়েছিলো।

চাকরি আমার হতো।
জেলার সব ছাত্রদের মধ্যে আমি যদি মাতৃভাষায়
প্রথম না হয়ে আপনাদের পিতৃভাষা অর্থাৎ
ইংরেজিতে প্রথম হতাম, হয়তো আমার বরাত
খুলে যেতো। অথবা আমার বন্ধুরা –
যারা ঠিক ঠিক জায়গায় তেল সরবরাহে
আরব রাষ্ট্রগুলিকেও হার মানিয়েছে –
আমি যদি তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায়
নামতে পারতাম তাহলে আমার গলায়
বাদামের ঝুড়ির বদলে নেকটাই ঝুলতো।

গর্তে-ঢুকে-যাওয়া ফ্যাকাসে হলুদ রঙের দুটো চোখের
শূন্য দৃষ্টি এবং একটা অকেজো টাইপ মেশিন ছাড়া
বাবা আমার জন্য আর কিছু রেখে যেতে পারেন নি।
এ বছর জীবনের সর্বশেষ ভোটটি দিয়ে মা চলে গেলেন। ভারতবর্ষ পড়ে রইলো।

আমার আর কোনো দায় নেই।
যেহেতু আজকের দর্শন আগামীকালের সংস্কার মাত্র
এখন যদি আমি সন্ন্যাসী হয়ে যাই।
বন্ধুরা বলবে, ‘পালিয়ে গেল’।
বিদেশি টাকায় পুষ্ট যে সব তথাকথিত
জনসেবা প্রতিষ্ঠান আছে – তাতে যদি
ভাতের জন্য ঢুকে পড়ি –
তারা বলবে, ‘ব্যাটা গুপ্তচর’।
যদি আত্মহত্যা করি –
তাহলে, ‘কাপুরুষ’।
আর যদি সোজাসুজি প্রতিবাদ করি –
তাহলে আপনারা, রাজনৈতিক নৈশ প্রহরীরা
কালো টাকার কুমিরদের অন্ধকার পাড়ায় গিয়ে
মাঝরাতে ‘নকশাল’ ‘নকশাল’ ব’লে
ঘেউ ঘেউ করে তাদের জাগিয়ে দেবেন
এমন কি অবস্থা তেমন তেমন বেগতিক দেখলে
আপনাদের সঙ্গে রাশিয়া আমেরিকাও যোগ দেবে।

এতদিন চাকরি খুঁজেছি। পাই নি।
এবার ভাবছি আমরাই আপনাদের চাকরি দেবো।
আমরা যারা বেকার আধাবেকার ভবঘুরে
বাউন্ডুলে ভিখিরি –
যাদের জমি নেই কিন্তু জমিতে খাটে –
বাড়ি বানায় কিন্তু বাড়ি নেই –
যারা শহরে আলো জ্বালে কিন্তু যাদের কুপিতে তেল নেই –
যারা কারখানা বানায়, কিন্তু কারখানা যাদের
আস্তাকুঁড়ে চালান করে দেয়

যারা কোনোদিন একটা ভালো জামা পরেনি,
সরবত খায় নি,
বেড়াতে গিয়ে পর্বতমালার স্তব্ধ নিরাসক্তি ও মহত্ত্বকে
স্পর্শ করেনি,
যারা জন্মায় আর খাটে, খাটে আর মরে,
যারা পিপড়ের মতো পোকামাকড়ের মতো
শীত-রাত্রির ঝরাপাতার মতো –

সেইসব নিরক্ষর নগণ্য কুঁজো অবজ্ঞাত করুণ
যাদের দেখার জন্য এবং ঠকাবার জন্য আপনারা
বিরাট মঞ্চে উঠে দাঁড়ান –
যারা আগামীদিনের ভারতবর্ষের, গোটা পৃথিবীর এবং
সৌরজগতের মালিক – আমি তাদেরই একজন হয়ে
এই জংশনে স্টেশনে বাদাম বেচে যাচ্ছি।
কশাইয়ের বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের মতো জীবন আমাদের –
যে-কোনো মুহূর্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারি – আবার
এই আঙুলের কেন্দ্রীভূত চাপে খোলা ফাটিয়ে বের করে আনা যায়
রাজনৈতিক ক্ষমতার পুষ্টিকর তৈলবীজ, আর সমস্ত শুকনো
খোসা
বাতাসে উড়ে যায়, বাতাসের সঙ্গে আকাশ স্পর্শ করে
মানুষের অনন্ত ঘৃণার আগুন –
সেই আগুনের পাশে বসে আছেন আমার মা,
আমার দেশজননী।

না, ‘বিপ্লব’ শব্দটি শুনলেই আপনাদের মতো
আমার কম্প দিয়ে জ্বর আসে না।