ভূমিকাঃ প্লাস্টিক দূষণ আমাদের সময়ের জটিল থেকে জটিলতম সমস্যাগুলির মধ্যে অন্যতম সমস্যা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। গত কয়েক দশক ধরে প্লাস্টিক উৎপাদন এবং ব্যবহারের আকাশছোঁয়া বৃদ্ধির ফলে আমাদের সমভূমি, মালভূমি, পাহাড়- পর্বত, সাগর-মহাসাগর – সবকিছুই প্লাস্টিকের জঞ্জালের স্তুপে পরিণত হয়েছে।

আধুনিক জীবনে প্লাস্টিকঃ প্লাস্টিক বর্তমানে আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে কথা বলছি, যেখানে খাবার খাচ্ছি- সবেতেই প্লাস্টিক আর প্লাস্টিক। সকালে ঘুম থেকে উঠলেই শুরু হয় প্লাস্টিকের ব্যবহার। এর পর আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত জলের বোতল, টিফিন বাক্স, লেখার কলম, ব্যাগ, মোবাইল ফোন, চেয়ার, টেবিল, খাবারের প্যাকেট – প্রায় সবকিছুই প্লাস্টিকের তৈরি। এমনকি আমাদের জীবন রক্ষাকারী সমস্ত ওষুধই প্লাস্টিকের মোড়কে প্যাকেটজাত থাকে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের ব্যবহার এতটাই বেশি যে, আমরা যদি এই বর্তমান সময়কে “প্লাস্টিকের যুগ” বলি, তা বোধহয় অত্যুক্তি হবে না।

প্লাস্টিক দূষণের প্রভাবঃ  আমরা প্রতিদিন যে পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যবহার করি তার বেশিরভাগই একবার ব্যবহার করার পরেই ফেলে দিই। আর সেই প্লাস্টিকের বেশিরভাগ গিয়ে পড়ে নর্দমায়, আর  নর্দমা থেকে নদীতে এবং শেষে নদী থেকে সমুদ্রে। আর এইভাবে প্লাস্টিক বছরের পর বছর জমা হতে থাকে সমুদ্রের তলদেশে।

সামুদ্রিক প্রাণী প্রায়শই খাবারের জন্য প্লাস্টিকের ধ্বংসাবশেষ ভুল করে খেয়ে ফেলে বা এতে জড়িয়ে পড়ে, যার ফলে আঘাত বা মৃত্যু হয়। জলে ভাসমান প্লাস্টিকের ব্যাগগুলি সমুদ্রের কচ্ছপগুলি গ্রাস করতে পারে। শুধুমাত্র সমুদ্রে পতিত হওয়া প্লাস্টিকের কারণে প্রায় ৮০০ প্রজাতির সামুদ্রিক জলজ প্রাণী নানা রোগে আক্রান্ত হয়৷ ধারণা করা হচ্ছে, শুধুমাত্র প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে সমুদ্র থেকে কচ্চপ একসময় বিলুপ্ত হয়ে যাবে। শুধুমাত্র জলজ প্রাণী নয়,  প্রায় ১০ লাখের মতো পাখিও প্রতিবছর প্লাস্টিক দূষণের শিকার হয়৷

প্লাস্টিকের বর্জ্য মাটিতে জমে থাকলে মাটি দূষিত হয়, মাটির উর্বরতা কমে, উদ্ভিদের বৃদ্ধি ব্যহত হয় এবং বন্যজীবনকে ক্ষতি করে। রাস্তায় পড়ে থাকা প্লাস্টিক ছাগল, গরু, বা কুকুর  প্রায়শই খেয়ে ফেলে, ফলে তাদের পেটের সমস্যা হয় এবং একসময় মারা যেতে পারে।

এছাড়াও প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা (মাইক্রোপ্লাস্টিকস) জল, মাটি ও বায়ুর মাধ্যমে আমদের শ্বাস বায়ুতে মিশে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে যা শুধু জলজ খাদ্যশৃঙ্খল ও জীবনকে বিপন্ন করে না, আমাদের জন্য স্বাস্থ্য ঝুঁকিও তৈরি করে। গবেষণা থেকে জানা যায় যে মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলি প্রদাহ, হরমোন জনিত ভারসাম্যহীনতা এবং এমনকি অঙ্গের ক্ষতি সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার দিকে পরিচালিত করতে পারে।

মাছ ধরা এবং পর্যটনের মতো  শিল্প পরিষ্কার পরিবেশের উপর নির্ভর করে। যখন প্লাস্টিকের দূষণের কারণে বাস্তুতন্ত্র এবং বন্যজীবন ক্ষতিগ্রস্থ হয়। প্লাস্টিক সম্পর্কিত সমস্যার কারণে মাছের মজুদ হ্রাস পায় যা জেলে ও মাছ ব্যবসায়ীদের জন্য অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। একইভাবে, প্লাস্টিকের বর্জ্য পদার্থে সমুদ্র -সৈকতগুলি ভরে উঠলে পর্যটনকেন্দ্রগুলি তাদের আকর্ষণ  হারাতে পারে।

প্লাস্টিক দূষণের বর্তমান প্রচেষ্টা এবং সমাধানঃ প্লাস্টিক দূষণ কোনো একটি অঞ্চলের বা দেশের সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা যার জন্য সম্মিলিত চেষ্টা এবং উদ্ভাবনী সমাধান প্রয়োজন।

পুনর্ব্যবহারঃ প্লাস্টিকের রিসাইক্লিং বা পুনরায় ব্যবহার করলে প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধ করা অনেকাংশেই সম্ভব। বর্তমানের বিজ্ঞানের আশীর্বাদে প্লাস্টিক বর্জ্য পদার্থকেও পুনর্ব্যবহারযোগ্য করা সম্ভব।

প্লাস্টিকের বিকল্প এবং টেকসই প্যাকেজিংঃ প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আরেকটি উপায় হ’ল প্লাস্টিকের বিকল্প এবং টেকসই প্যাকেজিং এর ব্যবহার। বর্তমানে পরিবেশ-বান্ধব বায়োডেগ্রেডেবল উপকরণ যেমন উদ্ভিদ-ভিত্তিক প্লাস্টিক ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। এছাড়াও কাঁচ, ধাতু এবং কাগজের মতো বিকল্প উপকরণগুলি প্যাকেজিং তৈরি করতে ব্যবহার করা হচ্ছে যা পুনর্ব্যবহারযোগ্য।

প্লাস্টিক দূষণ মোকাবেলায় আইনী ব্যবস্থাঃ বৃহত্তর আকারে প্লাস্টিক দূষণ মোকাবেলায় সরকারী হস্তক্ষেপ এবং নীতি ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ৫ মাইক্রনের চেয়ে কম পুরু প্লাস্টিকের উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। এছাড়াও সামগ্রিকভাবে প্লাস্টিকের উৎপাদন ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

উপসংহারঃ বর্তমান সময়ে প্লাস্টিক ছাড়া জীবন অচল। তবে আমাদের ও আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমাদের এই পৃথিবীকে সুন্দর রাখতে চাইলে আমাদের লাইফস্টাইলে পরিবর্তন আনতে হবে। পুনরায় ব্যবহারযোগ্য শপিং ব্যাগ, জলের বোতল এবং কফি কাপ বহন করার মতো সহজ জীবনযাত্রার পরিবর্তনগুলি  প্লাস্টিকের উপর আমাদের নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে পারে। প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সাধারণ মানুষদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে।