“কত অজানারে জানাইলে তুমি,
কত ঘরে দিলে ঠাঁই–
দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু,
পরকে করিলে ভাই।” – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভূমিকা : আমরা বর্তমানে যে বিশ্বে বাস করছি তা গঠনে বিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের খাবার থেকে শুরু করে বিদ্যুতের আবিষ্কার, আধুনিক ওষুধের বিকাশ- সবকিছুতেই বিজ্ঞান আমাদের জীবনে অগণিতভাবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এদিক থেকে বিজ্ঞান মানুষের প্রতিদিনের সঙ্গী ও বন্ধু।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান :  চিকিৎসা ক্ষেত্রে, বিজ্ঞান অবিশ্বাস্য অগ্রগতি করে চলেছে। অ্যান্টিবায়োটিক, ভ্যাকসিন এবং অন্যান্য চিকিৎসার আবিষ্কার অগণিত জীবন বাঁচিয়েছে এবং অনেকের জীবনের মান উন্নত করেছে। এক্স-রে, সিটি স্ক্যান এবং এমআরআই-এর মতো মেডিকেল ইমেজিং প্রযুক্তির বিকাশ ডাক্তারদের আরও সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা করতে সক্ষম করেছে। চিকিৎসাবিদ্যায় বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি না থাকলে, অনেক রোগ এবং অসুস্থতা যা একসময় মারাত্মক বলে বিবেচিত হত তা আজও নিরাময়যোগ্য হতো না। কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে বিজ্ঞান সমাজকে রক্ষা করার জন্য রেকর্ড সময়ে একটি ভ্যাকসিন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।

যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান : বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য সারা পৃথিবী আজকে আমাদের হাতের মুঠোয় এসে গেছে। রেডিও, টিভি, টেলিফোনের যুগ পেরিয়ে বর্তমান সময়ের ইন্টারনেট, স্মার্টফোন এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের বিকাশ আমাদেরকে সারা বিশ্বের মানুষের সাথে দ্রুত যোগাযোগ ও তথ্য আদানপ্রদান কর‍তে সাহায্য করেছে।

পরিবহনে বিজ্ঞান : পরিবহন ব্যবস্থায় বিজ্ঞান এনে দিয়েছে দুরন্ত গতি। প্রতিদিনের যাতায়াতকে বিজ্ঞান করে দিয়েছে সুগম, সুখকর ও নিরাপদ। এর ফলে সময়ের পাশাপাশি মানুষের শ্রমের লাঘব হচ্ছে। স্কুটার, বিভিন্ন ধরনের মোটরযান, বাস-লরি, ট্রেন, জাহাজ, উড়োজাহাজ ইত্যাদি যাত্রী ও মালপত্র পরিবহন সহজ ও সরল করে তুলেছে।

খাদ্য উৎপাদন ও গ্রহনে বিজ্ঞান : বিজ্ঞান আমাদের খাদ্য উৎপাদন ও গ্রহণের পদ্ধতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। কৃষিক্ষেত্রে যে সবুজ বিপ্লব ঘটেছে, তা আধুনিক বিজ্ঞানেরই দান। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বায়োটেকনোলজির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এমন ফসল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন যা কীটপতঙ্গ ও রোগ প্রতিরোধী এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জন্মাতে পারে। এটি ফসলের ফলন বাড়িয়েছে এবং বিশ্বের অনেক জায়গায় খাদ্য ঘাটতি কমাতে সাহায্য করেছে। উপরন্তু, বৈজ্ঞানিক গবেষণা আমাদেরকে বিভিন্ন খাবারের পুষ্টিমূল্য বুঝতে সক্ষম করেছে, যা স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং আরও ভালো স্বাস্থ্যের ফলাফলের দিকে পরিচালিত করে।

শক্তি উৎপাদনে বিজ্ঞান : শক্তি উৎপাদনে বিজ্ঞান একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।  সৌর, বায়ু এবং জলবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলির আবিষ্কার জীবাশ্ম জ্বালানির উপর আমাদের নির্ভরতা কমাতে সাহায্য করেছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে, আমরা শক্তি উৎপাদনের আরও দক্ষ এবং উন্নত পদ্ধতির বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছি, যা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিনোদনে বিজ্ঞান : আধুনিক যুগে বিজ্ঞানই এনে দিয়েছে বিনোদনের অফুরন্ত সম্ভার। একটা সময় ছিল যখন বিনোদনের মাধ্যম ছিল স্থানীয় নাচ, গান বা যাত্রাপালা। আজ আমরা সিনেমা হলে বা টেলিভিশন সেটের সামনে সন্ধ্যা কাটাতে পছন্দ করি। আর এখনকার সব বিনোদনই প্রায় মোবাইল ফোন কেন্দ্রীক হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞান বিনোদনকে নব নব বৈচিত্রের মাধ্যমে পরম আকর্ষণীয় করে মানুষের সামনে তুলে ধরেছে। যে হারমোনিয়াম, তবলা বাজিয়ে গান করা হয়, যে প্রকৌশলের ব্যবহারে রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করা হয়, অর্থাৎ বাদ্যযন্ত্র, মেকআপ, আলোকসম্পাত, দৃশ্য নির্মাণ সবকিছুতেই বিজ্ঞানের সহায়তা প্রয়োজন।

উপসংহার : বিজ্ঞান আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য দিক, এবং এর প্রভাব আমাদের অস্তিত্বের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনুভূত হয়। আমরা যে ওষুধ খাই তা থেকে শুরু করে আমরা যে খাবার খাই, আমরা যেভাবে যোগাযোগ করি, বিজ্ঞান আমাদের জীবনকে উন্নত করতে সাহায্য করেছে এবং আমাদের চারপাশের বিশ্বকে বদলে দিয়েছে। তবে বিজ্ঞানের এই বিশাল জয়যাত্রার কিছুটা কুফল অবশ্যই রয়েছে। আমরা ধীরে ধীরে যন্ত্রনির্ভর হয়ে যাচ্ছি যা অবশ্যই দুঃশ্চিন্তার কারণ। এছাড়াও বিভিন্ন কলকারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস ও রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করছে। তবে আমরা যদি সঠিকভাবে বিজ্ঞানের ব্যবহার করি, তাহলে মানবসভ্যতার উন্নতিই হবে।