"মাগো আমায় ছুটি দিতে বল
সকাল থেকে পড়েছি যে মেলা।"

ভূমিকাঃ পড়াশোনার একঘেঁয়েমি থেকে কে না ছুটি পেতে চায়! ছুটি মানে যেন খাঁচা বন্দি পাখির মুক্তি। এমনই একটি ছুটির দিন আমার জীবনে আজও চির উজ্জ্বল হয়ে আছে। এই ছুটি আর কয়েকটি ছুটির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।  এই ছুটি শুধু প্রতিদিনের স্কুল যাওয়া, ক্লাসের মধ্যে বন্দী হয়ে পড়াশোনা করা, সকাল বিকালের টাইমটেবিল থেকেই রেহাই পাওয়া নয়, এই ছুটি আমার জীবনে এনে দিয়েছিল এক অন্য অভিজ্ঞতা ও মুক্তির স্বাদ।

দিনটি কবে ও কোথায়ঃ সেদিন ছিল রাখি পূর্ণিমা। সকাল থেকেই আকাশ পরিস্কার, খুব বেশি রোদও নেই। আকাশ দেখে মনে হচ্ছিল, হালকা বৃষ্টি হলেও হতে পারে। তবে তা মন্দ লাগবে না আমাদের যাত্রা পথে। সকালে উঠেই বাবা জানিয়ে দিলেন, আমরা ঘুরতে যাব দার্জিলিং।  কথাটা শুনে আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমদের বাড়ি থেকে দার্জিলিং ১০০ কিলোমিটার। সকাল সকাল বেড়িয়ে গেলাম একটা সুমো গাড়ি ভাড়া করে। আমরা ছিলাম বাবা, মা, আমার বোন ও আমি। 

যাত্রাপথের বিবরণঃ আমরা এগিয়ে যাচ্ছি দ্রুত গতিতে। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, সমস্ত গাছপালা পিছনে সরে সরে যাচ্ছে। আমরা যখন শিলিগুড়ি পৌঁছালাম, তখন টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। দেখতে দেখতেই বৃষ্টি বাড়তে লাগল। রাস্তার ধুলোবালি সরে গিয়ে কী অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল কালো পিচের রাস্তাটা। আমরা রাস্তার পাশের একটা চায়ের দোকানের ভিতরে ঢুকে চা খেলাম। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। গাড়ি আবারও এগিয়ে চলছে। এবার আমরা সমতল থেকে পাহাড়ের দিকে উঠছি। আঁকাবাঁকা পথ, রাস্তার দুই পাশে ফুটে আছে রং বেরঙের জংলি ফুল, মাঝে মাঝে রাস্তায় জটলা করে আছে বানরগুলো। যতই উপরে উঠছি, ততই দেখছি রাস্তার দুইধারে শুধুই পাইন গাছ। মাঝে মাঝে রাস্তা থেকে দূরে পাহাড়ের দৃশ্য এতই ভালো লাগছিল যে, গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলছি আমরা। আমার বোনতো আনন্দে পাগলের মতো চিৎকার করছিল। এই ভাবে দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম দার্জিলিং। 

ছুটির দিনে কি কি দেখলামঃ দার্জিলিঙে আমরা পৌঁছালাম সকাল এগারোটায়। দেরি না করে, তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া সেরে বেড়িয়ে পড়লাম দর্শনীয় স্থানগুলো ভ্রমণ করতে। বাতাসিয়া লুপ ও গোর্খা যুদ্ধের স্মৃতিসৌধ, পদ্মজা নাইডু জুলজিকাল পার্ক, হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, চৌরাস্তা মল, অবজারভেটরি হিল ও মহাকাল মন্দির, জাপানি মন্দির, পিস প্যাগোডা, রক গার্ডেন ইত্যাদি জায়গা গুলো পরিদর্শন করলাম। আমার সবচেয়ে ভালো লাগছিল দার্জিলিংয়ের টয় ট্রেন ও রোপওয়ে। সময় কম থাকার জন্য আমরা টয় ট্রেনে উঠতে পারিনি।

ছুটির দিনের কেনাকাটাঃ দার্জিলিং এগিয়ে শুধুমাত্র ঘুরলামই না, কেনাকাটাও করলাম প্রচুর। বাবা, মা, বোন সবাই তাদের পছন্দমত সোয়েটার ও মাফলার কিনল। আমি নিয়েছিলাম একটা কালো রঙের জ্যাকেট যা এখনও আমি শীতে ব্যবহার করি। 

একটি ছুটির দিন ও আমাদের পরিবারঃ ঘোরাফেরা ও কেনাকাটা করতে করতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। বাবা বললেন আজ রাতটা দার্জিলিঙে কাটিয়ে দিই। আমি তো ভীষণ খুশি। এর আগে পাহাড়ে অনেক ঘুরেছি, রাত কোথাও কাটাইনি। হোটেল প্যারাডাইসে আমরা রাতটা থাকলাম। সন্ধে হতেও কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম,  রাতের দার্জিলিং। উপরে আকাশে মিটমিট করে তারারা জ্বলছে, নীচে আলোয় ভরে গেছে শহর। খুব গাইতে ইচ্ছে করছিল আমার – ” আহা, কী আনন্দ আকাশে বাতাসে।” রাতে আমরা একসাথে একই টেবিলে বসে খাবার খেলাম। বাবা আমাদের তার জম্মু-কাশ্মীর ট্রিপের গল্প শোনালেন।  সঙ্গে আরও জানিয়ে দিলেন, পুজোর ছুটিতে আন্দামান নিয়ে যাবেন জাহাজে করে। 

উপসংহারঃ পরের দিন সকালে ফিরে আসতে হল। সবারই ইচ্ছে আরও কয়েকটা দিন পাহাড়ে কাটায়ে যাই। কিন্তু উপায় নেই- আমার ও বোনের স্কুল আছে, বাবার অফিসের কাজ আছে, মায়েরও অনেক কাজ বাড়িতে। ফেরার সময় বাইরে তাকিয়ে আছি, সব সরে সরে যাচ্ছে পিছনে। আমার মনে তখনও ভাসছে দার্জিলিং শহর, তার অপরুপ শোভা। আজও যখন একলা শুয়ে থাকি, কোথাও ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে হয়, প্রথমেই দার্জিলিঙের কথা মাথায় আসে, মনে পড়ে যায় সেই রাখিপূর্ণিমার দিনে দার্জিলিং ভ্রমণের কথা, পুরো পরিবারের সঙ্গে একটি ছুটির দিন কাটানোর অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা ভুলে যাওয়ার নয়, এটি আমার মনের গভীরে চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।